'ওঙ্কার' - বাঁধ ভাঙার আওয়াজ
উত্তম পুরুষের জবানিতে লিখিত ক্ষুদ্র উপন্যাস 'ওঙ্কার'। অনামা নায়কের ভাষ্যে পাকিস্তান আমলের সমাজচিত্রের ক্যানভাসে বিশেষ ঔজ্জ্বল্যে উঠে এসেছে গুটিকয় সামাজিক অসংগতি এবং গুরুত্বপূর্ণ মনস্তত্ত্ব।
ছফা সাহেব প্রথাগতভাবে উপন্যাসে ইঙ্গিতপূর্ণ কোনো সূচনা না রেখে সরাসরি যেভাবে ঘটনার বর্ণনায় মন দিয়েছেন, তেমনি একটা হঠাৎ সমাপ্তিতে চমক দিয়েছেন পাঠককে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত একটি কথাও বলেননি তিনি।
মোটাদাগে 'ওঙ্কার' দুটো ভাগে বিভক্ত। আর তাতে দুটো চরিত্রের ওপর বিশেষ গুরুত্ব পড়েছে। ফলে সামাজিক অসংগতি এবং মনস্তত্ত্ব এ চরিত্রদ্বয় ঘিরে পরিমিতভাবে যথাক্রমে বিশ্লিষ্ট হয়েছে। আমরা নায়কের বিয়েকে মাঝে রেখে দুটো ভাগ কল্পনা করলে আলোচনায় সুবিধা হবে।
বিয়ের আগে -
এই ভাগে নায়কের বাবার জয়জয়কার। তাঁর চরিত্রে ভাববাদী বৈশিষ্ট্যের প্রচণ্ড প্রতিফলন। দুঃখ-দুর্দশায় আল্লাহই তাঁর চূড়ান্ত ভরসা। শুরুর দিকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত মেজাজের কথাও এসেছে। আগের দিনে মানুষ বলত "রাগের জমিতে ফসল ফলে না"। এ চলতি কথাই শেষমেশ ফলে গেল তাঁর জীবনে। মিথ্যে মামলায় ফেঁসে গেলেন তিনি। আর তার ফায়দা লুটলেন আবু নসর মোক্তার - নিজের মেয়ের সদ্গতি করে।
জেনারেশন গ্যাপ ব্যাপারটা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়েছে নায়কের বাবার হাবেভাবে। যুগের সাথে তাল মেলাতে ব্যর্থ একজন হিসেবে তাঁকে আমরা পাই। অন্তরীণ সিংহ, সহায়হীন মাতাল, পুরনো মডেলের গাড়ির সাথে উপমায় আর তুলনায় আমাদের সামনে চরিত্র হিসেবে বাবাকে জীবন্ত বাস্তব করে তুলেছেন আহমদ ছফা।
উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত সামান্য জমির তালুকদারি উপভোগ করতে গিয়ে বেশ খানিক হাস্যরসের উৎপাদন করেছেন কথিত 'ফুটো তালুকদার'। বাবার মামলাবাজির প্রবণতা প্রকাশ পেয়ে গেছে। তখনকার যুগের মানুষের মামলা করার প্রবণতায় আমাদের দেশের বিচারহীনতার সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। স্বাভাবিকের তুলনায় মামলার সংখ্যাধিক্য বিচারে দীর্ঘসূত্রিতা তৈরি করে। প্রায় মামলাই বিচারহীন নিষ্পত্তি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। এ সত্য একটু মাথা খাটালেই বোঝা সম্ভব।
প্রভাবশালীদের মামলাবাজির সাথে উকিল মোক্তারদের ঘুস গ্রহণের প্রবণতাও 'ওঙ্কার' উপন্যাসে এসেছে। এসেছে উচ্চক্ষমতার জোর কাজে লাগিয়ে সরকারি অফিসের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার চাকরি বাগানোর কুচর্চা। এ চর্চার আলোকপাতেই উপন্যাসের ঘটনা নতুন পথে মোড় নেয়।
বিয়ের পরে -
নায়কের বিয়ের পর ধীরে ধীরে নসর মোক্তারের অভিসন্ধি প্রকাশ পেতে থাকে। এক পর্যায়ে নিপাট স্বার্থপরতা ছাড়া তার আর কোনো দোষগুণের হদিস করতে পারার উপায় থাকে না।
গোটা উপন্যাসে অনামা নায়ককে কেবল কথক হিসেবেই সক্রিয় মনে হবে। চারপাশের এটায়-সেটায় তার কিছুই আসে যায় না। তবু একটা-দুটো বিশেষ ক্ষেত্রে তার মনোজগৎ নিয়ে খেলা করেছেন ঔপন্যাসিক।
অফিসের এক সহকর্মী নৃপেন - বউপাগলা এ চরিত্রটির নিরিখে নায়কের মধ্যে ভাবের পরিবর্তন সূচিত হতে দেখা যায়। যে বাকপ্রতিবন্ধি স্ত্রীকে চাপে পড়ে মেনে নিতে হয়, নৃপেনের প্রভাবে একপর্যায়ে তাকেই মেনে নিতে না পারার বেদনা ধরা পড়ে নায়কের চারিত্রিক গতিবিধিতে।
এই জায়গাটিতে কিছুটা বঙ্কিমীয় আদর্শে কাহিনীর নির্মাণ অনুভূত হয়। 'কৃষ্ণকান্তের উইল' উপন্যাসে গোবিন্দলাল তার জীবনে ভ্রমরের অস্তিত্ব থাকতেও উঠোনে দাঁড় করানো সৌন্দর্য্যমূর্তির পাশে এসে দাঁড়িয়ে রয়। নারীর গায়ের রঙ যদি তার সৌন্দর্য্য হয়, তবে তার কণ্ঠস্বরও ত এক অর্থে তা-ই। না হয় ভগ্নমনোরথ নায়ক নিজের বোনকে কেন গানের তালিম দিয়ে ফেলবে সে প্রেক্ষিতে?
এ সময়টা স্ত্রীকে একরকম অবহেলাই করে নায়ক। অথচ এ ব্যাপারটিই এভাবে বিপরীত মনোবিজ্ঞান (reverse psychology) রূপে কাজে লেগে যাবে, কে ভেবেছিল?
নায়কের প্রেমিকসত্তার জাগরণ এখানে।
উপন্যাসের সময়রেখার বিবেচনায় নায়িকা চরিত্রটির মনোজগত যথেষ্ট বিকশিত। হতে পারে তার বাকশক্তির হীনতা এর একটা প্রচ্ছন্ন কারণ। চোখে-মুখে কথা বলতে চাওয়ার আকাঙ্ক্ষা থেকে কী না করেছে সে!
এরপর ধীরে ধীরে উপন্যাসের পরিণতির সাথে সাথে দেশের পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়েছে। উন্মোচিত হয়েছে প্রেমিক পুরুষের কাপুরুষতার স্বরূপ।
অবাক হয়ে দেখার বিষয় একজন বাকপ্রতিবন্ধি কতটা মুখিয়ে থাকে বাকমুখরতায় সজীব হবার প্রচেষ্টায়! শেষমেশ রক্তের দেয়াল দাঁড়িয়ে যায় প্রকৃত মিছিল আর মিছিলে সামিল হবার দুর্নিবার ইচ্ছের মাঝখানে। এ সংজ্ঞাহীন চেতনা নায়কের মধ্যে সংক্রমিত হয় কি না তা আমরা জানি না। জানি না এ নিয়েও উপন্যাস হয় কি না। আহমদ ছফা করে দেখিয়েছেন।