হেমলকের নিমন্ত্রণ pdf download | সুজন দেবনাথ

 



আমার একটা অদ্ভুত ইচ্ছে আছে। মৃত্যুর পর সৃষ্টিকর্তার কাছে যদি কিছু চাওয়ার সুযোগ পাই, তাহলে এই পুরো পৃথিবীটা কীভাবে একের পর এক ঘটনার মাধ্যমে আজকে রূপ ধারণ করেছে তা দেখতে চাইবো। এক সময়ের পৃথিবীতে এক দুইজন মানুষের সিদ্ধান্তই আজকের পুরো পৃথিবীর রূপরেখা গড়ে দিয়েছে। এখনকার পৃথিবীতে সেটা সম্ভব হয় না অনেক কারনেই। আমার দেখতে ইচ্ছে করে সেইসব সময়গুলোকে যার উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে আজকের পৃথিবী।


যাহোক প্রাচীন পৃথিবী সম্পর্কে আমার এই জানার আগ্রহের একটা অংশ পূরণ হলো "হেমলকের নিমন্ত্রণ" বইটির মাধ্যমে। লেখক সুজন দেবনাথের সুন্দর এবং প্রাঞ্জল লিখনশৈলীর মাধ্যমে গল্পে গল্পে পৃথিবীর অনেক "প্রথমের" শুরু সম্পর্কে বেশ চমৎকার একটা ধারণা পেলাম। মনে হচ্ছিল যেন আমি চলে গিয়েছি আড়াই হাজার বছর আগের সেই এথেন্সে। কল্পনায় বসে রয়েছি এজিয়ান সাগরের পাড়ে। হেঁটে বেড়িয়েছি আগোরার পথ ধরে, এলোপেকি পাহাড়ে বসে উপভোগ করেছি ভরা পূর্ণিমা রাতের সৌন্দর্য, হাত তালি দিয়েছি ডিওনিসাসের থিয়েটারে বসে। কিছু বই থাকে না যেগুলো পড়ার পর মনের খোরাক মিটেছে টাইপ অনুভূতি হয়, এটা তেমনি একটা বই। এমন বইয়ের রিভিউ লেখা কষ্টের কাজ, তবুও শুরু করা যাক।


আমি পৃথিবীতে এসেছি শুধুই ভালোবাসার জন্য, কখনোই ঘৃণা করার জন্য নয়। -- সফোক্লিস


চমৎকার একটা ভূমিকার পর বইয়ের প্রথম বাক্যটা পড়েই আমি আসলে বইটার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। মনে মনে ভেবেছিলাম বইটির গদ্যশৈলী হয়তো একটু গুরুগম্ভীর প্রকৃতির হবে। কোথায় কী! এ যে একেবারে তরল, হালকা চালের রসিকতা সম্পন্ন লেখা। এভাবেই কি হিউমার সম্পন্ন একটা গল্পের মাধ্যমে তাহলে আমি জানতে যাচ্ছি পৃথিবীর প্রথম বিজ্ঞান, গণতন্ত্র, দর্শন, ইতিহাস, স্থাপত্য, ট্রাজেডি, কমেডি, চিকিৎসা শাস্ত্রের ব্যাপারে? এত সহজ আর সুন্দরভাবে কি পুরোটা বই জুড়ে লেখক লিখে যেতে পারবেন? দুটো প্রশ্নের উত্তরই, হ্যা। বইয়ের প্রতিটি চরিত্রই ঐতিহাসিক এবং বাস্তব। এই বাস্তব চরিত্রদের মাঝে কখনো সক্রেটিস, কখনো বা ইউরিপিডিস কিংবা পেরিক্লিস, ফিডিয়াস, হেরোডোটাস, সফোক্লিস, হিপোক্রাটিসদের বয়ানে লেখক একে একে তুলে এনেছেন গণতন্ত্র শুরুর ইতিহাস, চিকিৎসা শাস্ত্রের ইতিহাস, পৃথিবীর প্রথম ঐতিহাসিক গ্রন্থের ইতিহাস, অলিম্পিক, ম্যারাথন শুরুর ইতিহাস। পাশাপাশি এথেন্সের তৎকালীন আর্থিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক পরিবেশও উঠে এসেছে বইতে। এসেছে গ্রীক দেবতাদের কথা, ট্রয় কিংবা পেলোপনেশিয়ান যুদ্ধের কথা, হোমারের ইলিয়াদ এবং অডেসির কথাও। প্রতিটা অধ্যায় শুরু হয়েছে সে সময়কার বিভিন্ন মনীষীদের চমৎকার সব উক্তি দিয়ে। একেকটা উক্তি মনের অন্দরকে নাড়িয়ে দেয়ার মত।  


শুরুর দিকের বড় একটা অংশ হিউমার দিয়ে সাজিয়েছেন লেখক। সক্রেটিস ও তার বন্ধুদের খুনসুটি আর প্রশ্ন প্রশ্ন খেলা শুরুর এক চতুর্থাংশের মূল উপজিব্য। এসব হাস্যরসের ফাঁকেই আমরা জেনে যাই, পৃথিবীর প্রথম থিয়েটার এবং মঞ্চ নাটক শুরু হওয়ার ইতিহাস সম্পর্কে। চেরোফোনের উৎসাহী কণ্ঠে জানতে পারি পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে এথেন্স নগর গড়ে উঠার গল্প। আর ইউরিপিডিস আমাদেরকে জানান ট্রয়ের যুদ্ধের ঘটনা। এ সময়ে বইয়ে এমন অনেকগুলো বাক্য আছে যা মার্ক করে রাখার মতো। তবে তার মাঝে: 'ভালোবাসার সবচেয়ে শুদ্ধতম রূপ হলো, জ্ঞানের প্রতি ভালোবাসা' --- এই বাক্যটা আমার সবচেয়ে প্রিয়। 


'পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজ হলো নিজেকে জানা আর সবচেয়ে সহজ কাজ হলো অন্যকে উপদেশ দেওয়া।' -- থেলিস 


ধীরে ধীরে বইয়ের টোন কিছুটা গাম্ভীর্য ধারণ করতে শুরু করে। গল্পে চলে আসে এথেন্সের রাজনৈতিক ব্যাপার স্যাপার। আর সক্রেটিস থেকে ফোকাস সড়ে যায় পেরিক্লিসের দিকে। পেরিক্লিস আর আশপাশিয়ার ভালোবাসার গল্পের মাঝে, বক্তৃতার স্বরে পেরিক্লিস আমাদেরকে জানিয়ে দিয়ে যান ডেমোক্রেসি শুরুর প্রেক্ষাপট। পরিচয় হয় সলোন নামের এক মহামানবের সাথে। ইতিহাসের শাস্ত্রের জনক হেরোডোটাসের সাথেও পরিচয় হয় আমাদের। তার বয়ানে আমরা জানতে পারি পারস্য এবং গ্রীসের মধ্যে হওয়া প্রথম "ম্যারাথন" যুদ্ধ সম্পর্কে। যে যুদ্ধে ফিডিপিডিসের দৌড়ের সম্মানে আজও ম্যারাথন দৌড় প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। গল্পে গল্পে জানা হয় অলিম্পিক প্রতিযোগিতা সম্পর্কে। আমার জানা ছিল না গ্রীক পূরাণের বীর হারকিউলিসের কল্যানে খেলার মাঠের নাম স্টেডিয়াম হয়েছে! স্পার্টার বীর রাজা লিওনিদাসের ৩০০ সেনা নিয়ে পারস্যকে রুখে দেয়া যুদ্ধের গল্পও বলে ফেলেন লেখক। হেরোডোটাস আর সফোক্লিসের আড্ডায় জেনে নেই গ্রিক ট্রাজেডির জনক এস্কিলাসের আদ্যোপান্ত। এছাড়াও এথেন্সকে রূপসী নগরে সাজানোর সব পরিকল্পনা আর তার কারিগরদের ব্যাপারেও গল্পে গল্পে জানিয়ে যান লেখক। বইয়ের মধ্যম ভাগের এই অংশের সবচেয়ে মজাদার অংশ হলো চেরোফোন আর সক্রেটিসের ডেলফির ওরাকলের কাছে যাওয়ার অংশটুকু।  


মানুষ মাত্রই ভুল করে। কিন্তু যে মানুষ ভুল বুঝতে পারামাত্র সংশোধন করে, সেই হলো ভালো মানুষ। মানুষের একমাত্র অপরাধ হলো অহংকার। -- সফোক্লিস।


গ্রীসের দেবতা ভিত্তিক চিকিৎসা ব্যবস্থা বাদ দিয়ে নতুন ধরণের এক চিকিৎসা ব্যবস্থার চিন্তা এসেছে এক কস দ্বীপের এক তরুণের মাথায়। তার নাম হিপোক্রাটিস। চিকিৎসা শাস্ত্রের জনক এই ভদ্রলোক। এমনকি আজও সকল ডাক্তারদেরকে উনার লেখার শপথবানী পাঠ করতে হয় ডাক্তারি পাশ করার পর। পৃথিবী বদলে দেয়া তার ডাক্তারি সম্পর্কে সবটাই লেখক জানিয়ে গিয়েছেন যথারীতি গল্পের মাধ্যমে। পৃথিবীর প্রথম ইতিহাস গ্রন্থের লেখক হেরোডোটাস কীভাবে নিজের সেই বইয়ের মাধ্যমে প্রাচ্য আর পশ্চিমের মাঝে এখনো বহমান সংঘাতের সূচনা করে দিয়ে যান, সেটাও জানা যাবে বইয়ের এই পর্যায়ে।* সৃষ্টিসুখের উল্লাস ছেড়ে আমরা চলে আসি স্পার্টা আর এথেন্সের মধ্যকার দীর্ঘ এক যুদ্ধের শুরুর পরিস্থিতিতে। স্পার্টার আক্রমণে কীভাবে শিক্ষা, শিল্প, সাহিত্য, দর্শন আর জ্ঞানের মহিমায় উদ্ভাসিত এথেন্স ধীরে ধীরে নিঃশেষ হতে থাকে সেটাও পাঠক জেনে যাবে এখানে। স্পার্টার পাশাপাশি এথেন্সে আঘাত হানে ভয়াবহ প্লেগ। যে প্লেগে এথেন্স হয়ে যায় লাশের নগরী। মারা যায় তাদের সকল সূর্য সন্তানেরা। যে পেরিক্লিস দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে এথেন্সকে পৃথিবীর সেরা নগরে পরিণত করেছিলেন, সেই পেরিক্লিসের বিরুদ্ধেই চলে যায় এথেন্সের নাগরিকরা। একের পর এক বন্ধু বিয়োগ আর মামলায় বিপর্যস্ত পেরিক্লিস পড়েন সর্বনাশা প্লেগের থাবার নিচে। এই সময়টার কি করুণ এক বর্ণনা যে লেখক লিখেছেন! পেরিক্লিসের শেষ সময়টার সে বর্ণনা পড়ার সময়ে কখন যে চোখ ভিজে উঠেছে তা টেরই পাইনি।  


তোমার সাথে যেটি করলে তুমি কষ্ট পাও, 

 সেটি কোনোদিন অন্যের সাথে কোরো না। -- সক্রেটিস  


ধীরে ধীরে চলে এলাম আমরা বইয়ের শেষ ধাপে এবং সবচেয়ে বড় ট্রাজেডি সক্রেটিসের মৃত্যুর অংশ। বইয়ের মাঝামাঝিতেই আমাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয় এক চরিত্রের সাথে। যার কারনেই এই শেষ অংকের করুণ দৃশ্যের সূচনা হয়। সক্রেটিস কেন হেমলক পান করতে রাজী হলেন, কেন মেনে নিলেন প্রহসনের এই বিচার, কেনোই বা সুযোগ থাকা সত্ত্বেও জেল থেকে পালাতে রাজী হলেন না তার সবটাই উঠে এসেছে এখানে। মরে গিয়েও অমর হয়ে রইলেন সক্রেটিস নিজের কর্মের দ্বারা। আড়াই হাজার বছর পরেও ইতিহাস তাকে মনে রেখেছে। এর বড় একটা কৃতিত্ব দার্শনিক প্লেটোর। প্লেটোর জন্ম থেকে উত্থান সবটাই অল্প কথায় চমৎকারভাবে জানিয়েছেন লেখক। বইয়ের শেষ অংশ পড়ে মন খারাপ হলেও, বইটা আসলে বিরাট একটা তৃপ্তি এনে দিয়েছে আমার পাঠক মনটাকে। নিঃসন্দেহে আমার পড়া শ্রেষ্ঠ বইগুলোর মাঝে অন্যতম সেরা বই এটা। 


ব্যক্তিগত রেটিং: ১০/১০ ( লেখকের গদ্যশৈলীর দরুণ এমন ইতিহাস সমৃদ্ধ বইও হয়ে গিয়েছে একটা গল্পের বইয়ের মতো। লেখককে আন্তরিক ধন্যবাদ এমন বই উপহার দেয়ার জন্য। উনার কাছ থেকে এমন আরো অন্যান্য দেশের ইতিহাস সম্পর্কে জানার আগ্রহ তৈরি হলো। সকল ধরণের পাঠকদের জন্য অবশ্যপাঠ্য বই এটা। কেউ এই বইটা ফেলে রাখবেন না প্লিজ। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পড়ে ফেলুন। শুধু গল্প বা ইতিহাসের জন্য না, নিজের আত্ম-উন্নয়নের জন্য, নিজেকে আরো পরিশুদ্ধ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্যও বইটা পড়া উচিত। এই বইটাকে মনে ধারণ করতে পারলে হিংসা, ঘৃণা, রাগ আর অহংকারকে দমিয়ে রাখা শিখতে পারা সম্ভব বলে মনে করি) 


প্রোডাকশন: বইটির প্রোডাকশন অত্যন্ত চমৎকার। পেইজ কোয়ালিটি হতে বাঁধাই সবই ভালো। বর্তমানে থাকা বইয়ের নতুন এডিশনের প্রচ্ছদের তুলনায়, আমার কাছে থাকা আগের এডিশনের প্রচ্ছদটা আমার খুব খুব পছন্দের। বইয়ের শেষ লাইনটা পড়লে এই প্রচ্ছদটার মাহাত্ম্য আরো বেড়ে যায়। এমন একটা বই হিসেবে বইটির দামও বেশ সহনীয় বলেই মনে করি। প্রকাশনীকেও ধন্যবাদ বইটির জন্য। 


পুনশ্চ: মূল রিভিউর বাইরে বইটার ব্যাপারে কিছু বাড়তি তথ্য যোগ করা প্রয়োজন বলে মনে করছি। প্রথমত বইটার গদ্যশৈলী হাতে নিয়ে টানা পড়ে যাওয়ার মতো হলেও, আমি ব্যক্তিগতভাবে বইটার নির্যাস উপভোগ করতে হলে ধীরস্থির ভাবে পড়া প্রেফার করবো। দ্বিতীয়ত লেখকের ভূমিকাটা মিস দিবেন না, ওটা অবশ্যই পড়বেন পুরো বইটার টাইমলাইন এবং ভাষাশৈলীর ব্যবহারের ব্যাপারে তাহলে একটা আইডিয়া তৈরী হবে। এই বইয়ের মূল উপজিব্য সক্রেটিসের জীবন। রক্ত মাংসের সক্রেটিসকে অনুভব করানোর চেষ্টা করেছেন লেখক। রিভিউতে উল্লেখ করা বইয়ের সকল ইতিহাস এসেছে সক্রেটিসের জীবনকালের সময়ের মধ্যে ঘটা একটা লম্বা গল্পের ফাঁকে ফাঁকে। সেই গল্পটা আমি রিভিউতে আনতে পারিনি। আনতে পারিনি ক্রিতো, আশপাশিয়া সহ আরো অনেক চরিত্রের অনেক রকম কর্মকান্ডকে। সবকিছু মিলিয়ে এটা দূর্দান্তের চেয়েও বেশীকিছু। 


বইটির পিডিএফ লিংক

লিংক ১ | লিংক ২ | লিংক ৩ ]

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

buttons=(Accept !) days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Learn More
Accept !