ধাত্রীদেবতা - তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়

 


"ধাত্রীদেবতা" উপন্যাসের মূল নায়ক জমিদারের ছেলে শিবনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে ঘিরে পুরো গল্প আবর্তিত হয়েছে। খুব অল্প বয়সে শিবনাথের বাবা মারা গেলেও তার বিধবা পিসি শৈলজা-ঠাকুরানী জমিদারির দেখভাল করেন। শিবনাথের মা তো ছিলোই তাছাড়া মায়ের চেয়ে অধিক হয়ে ওঠে তার পিসিমা শৈলজা-ঠাকুরানী। ইংরেজ শাসনের শেষদিকে যখন জমিদারি প্রথা বিলুপ্তির পথে তখনকার গল্প এটি। শিবুর পিসিমা ছোটতেই শিবুকে নান্তি নামের এক মেয়ের সাথে বিয়ে দিয়ে দিলেও দাম্পত্য জীবন তাদের খুব সুখের হয় না। একদিকে শিবনাথের পিসিমা শৈলজা-ঠাকুরানী অপর দিকে শিবনাথের সদ্য বিবাহিত বালিকা বধূ নান্তি, দুয়ের মাঝে মনমালিন্যের জন্য শিবনাথের জীবনে অশান্তির শেষ থাকে না। শিবনাথের জনহিতকর কাজে জড়িয়ে পরাকে তার মা-পিসিমা সমর্থন করে গেলেও সেই সময়ের একটা সময় বানোয়াট কুৎসা নান্তির কানে গেলে নান্তি শিবনাথের বাড়ি আসতে অসম্মতি জানায়। এর ফলে রাগ, অভিমান সেই সাথে নিজেদের মনের দূরত্ব আরো বাড়তে থাকে৷ একটা সময় নান্তি শিবনাথের বাড়িতে অল্প সময়ের মধ্যে আসা যাওয়া করলেও মনের কোন্দল মেটে না৷ কলকাতায় কলেজে পড়ার সময় শিবনাথ একসময় স্বদেশী আন্দোলনে জড়িয়ে পরলেও শেষে সে সেই সহিংস আন্দোলনের পথ থেকে সরে আসে। শিবনাথের মা সেই সময় মারা গেলে তার পিসিমা শিবনাথের দাম্পত্য সুখের কথা চিন্তা করে নান্তির হাতে সংসার তুলে দিয়ে কাশী চলে যায়। কিন্তু তারপরও শিবনাথের সাথে নান্তির মনমালিন্য মেটে না বাপের বাড়ির লোকেদের জন্য। শিবনাথ নিজের দেশ/ধাত্রীকে অন্যভাবে দেখে। একসময় বাড়ি ছেড়ে অনেক দূর গিয়ে বছর আড়াই থাকলেও মনের মতো উত্তর না খুঁজে পেয়ে চলে আসে শিবনাথ। গান্ধীজির ডাকে অহিংস আন্দোলনে জড়িয়ে পরলে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। তখন সংসারের টালমাটাল অবস্থা। নান্তি সেই খবর পায় এবং কোলকাতা শহরের অবস্থা চাক্ষুষ দেখে নিজের ভুল বুঝতে পারে। যে শিবনাথকে নিয়ে তার এতোদিন হীনমন্য বোধ হতো সেই শিবনাথকে নিয়ে তখন নান্তির গর্ব হয়। সে তাদের ছেলেকে নিয়ে শিবনাথের বাড়ি ফিরে আসে। সবার চাপে পরে পিটিশনে সই করিয়ে শিবনাথকে হয়তো বের করেও নিয়ে আসতো কিন্তু খবর পেয়ে কাশী থেকে শিবনাথের পিসিমা শৈলজা-ঠাকুরানী এসে তাতে অসম্মতি জানায়। কিন্তু তারা শিবনাথের সাথে জেলে দেখা করতে যায়। শিবনাথের তখন দারুণ এক অনুভূতি হয় যে তার পিসিমাই তো ধাত্রী। সকলে মিলেই তো দেশ৷


"ধাত্রীদেবতা" উপন্যাসকে অনেকটা তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের আত্মজীবনী বলা যেতে পারে। খুব যদি ভুল করে না থাকি তাহলে এই উপন্যাসের আগের নাম ছিলো "জমিদারের মেয়ে"। মূলত একটি ভগ্নপ্রায় জমিদার পরিবারিবারকে ঘিরে এর বিন্যাস। তারাশঙ্করের আর সকল উপন্যাসের মতোন এই উপন্যাসেও প্রকৃতির সুনিপুণ গন্ধ মেশানো। একদিকে বাংলার সবুজের স্নিগ্ধতা অপর দিকে বিহারের কাটখোট্টা জঙ্গল-মাটি মিলেমিশে একাকার। মা আর পিসির সুদৃঢ় বন্ধনে শিবনাথকে দশের করে গড়ে তোলার প্রচেষ্টা। না চাইলেও হারিয়ে যেতে হয় মোহনীয় সব বর্ণনার মাঝে৷ 

অর্ধাঙ্গের সাথে অর্ধাঙ্গিনীর সামান্য অভিমান হৃদয়ের কতোদূর পর্যন্ত ক্ষতের সৃষ্টি করতে পারে তা শিবনাথ আর নান্তিকে দেখলেই যে কোন পাঠক বুঝতে সক্ষম। দুজন দুজনার পরিপূরক হয়ে উঠতে পারলেও কখনো মৌখিক ব্যবহারে তা বোঝা যায় না। মানুষ না চাইতেও তার প্রিয়জনদের কষ্টের কারণ হয়৷ নয়তো প্রিয়জনদের কারণেই কষ্টের মাঝে বাস করে৷ অথচ কেউই কিন্তু কারো ক্ষতি চায় না। ওই যে 'না চাইতেই'। যখন নিজের দোষটা নিজের কাছে ধরা পরে তখন হয়তো সেই কাছের মানুষ অনেকটা দূরে চলে যায়। শিবুর মা-পিসিমার মতো যদি নান্তিও পালিয়ে না গিয়ে শিবুকে কাছে থেকে দেখতো জানতো তবে হয়তো তাদের মধ্যকার ভুলবোঝাবুঝি হতোই না। আবার সেই ভুলবোঝাবুঝি না হলে উপন্যাসও থেমে থাকতো এক ছোটগল্প হিসেবে। দূর ছাই কিসব লিখছি। 

ছোটবেলায় শিবনাথ তার মায়ের কাছে শোনা বঙ্কিমচন্দ্রের 'আনন্দমঠ' এর মতো করে দেশকে উপলব্ধি করতে চাইতো৷ তাই তো সে নিজেকে ধাত্রীর কাছে বারবার উজার করে দিয়েছে। কখনো কলেরা রোগীদের সেবা করে, কখনো দূর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষদের জন্য নিজের গোলার ধান বা নগদ অর্থ দিয়ে, কখনো স্বদেশী আন্দোলনে জড়িয়ে। শেষমেষ সে দেশ খুঁজে পায় তার মা-পিসিমার শিক্ষায়, পিসিমার মাঝে, নিপীড়িত লোকদের পাশে থেকে, গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলনে জড়িয়ে জেলে গিয়ে।

"যে ভার যার বইবার, সে যে তাকেই বইতে হবে বাবা। রেহাই নোব বললেই কি মানুষ রেহাই পায়, না রেহাই দেবার মানুষই মালিক?" মানুষের কর্ম জগৎসংসারে আসবার আগেই ঠিক হয়ে আসে। লেখনীর গুণে শেষদিকে পাঠক তার আপন দর্শনবোধের পসরা খুলে বসলেও তাতে তাকে দোষ দেওয়া চলবে না।


যারা চমকদার, চটকদার, তরতরিয়ে চলা লেখা পড়তে ভালোবাসেন উপন্যাসটি তাদের জন্য নয়৷ উপন্যাসটি সামান্য ধীরগতির। যা দু'দন্ড পাঠককে থামাবে, ভাবাবে। হাত ধরে হারিয়ে দেবে আবার পথও দেখিয়ে দেবে৷ তারাশঙ্কর বন্ধ্যোপাধ্যায়ের লেখনী এমনই৷


"ধাত্রীদেবতা"

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়৷

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

buttons=(Accept !) days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Learn More
Accept !