কর্নেল সমগ্র - সৈয়দ মুস্তফা সিরাজ

 


রহস্যভেদী বুড়োর গল্প


মর্শিদাবাদ। পুরনো এক কবরস্থান। পাহারাদার বুড়ো ইয়াকুব বড় হতাশ। এই অখ্যাত গোরস্থানে কোনো পর্যটকই আসে না। এমনকী অল্প-বিস্তর বখশিশও জুটে না তার। তারপরই এক সন্ধ্যায়, তখন মাগরিবের সময়, দামি এক স্টেশন ওয়াগনকে গোরস্থানের দোরগোড়ায় এসে দাঁড়াতে দেখে চমকে উঠল ইয়াকুব, সেই সঙ্গে আশা ডালপালা মেলতে লাগল মনে।


গাড়িটাতে ছিল সিনেমার পরিচালক সোমনাথ ও তার পরের ছবিতে অভিনয়ের জন্য নির্বাচিত চার শিল্পী। এদের দুজন আবার সুন্দরী নারী। বৃষ্টি ঝরা ওই রাতে পাঁচজন আশ্রয় নিল গোরস্থানের সীমানার ভেতরের পড়ো পড়ো দু-তলা দালানটায়। গভীর রাতে কবরস্থানে ঘটল গা শিউরানো কাণ্ড। সোমনাথ একটা কবরের ওপর আবিষ্কার করল ইয়াকুবের মৃতদেহ। ঠোঁটের চারধারে ফেনা। পাশে পড়ে আছে একটা শাবল। তারপরই আরেকটা কবরের ওপর একই ভঙীতে পড়ে থাকতে দেখা গেল বৃদ্ধের তরুণী স্ত্রীর মৃতদেহ। ডাক পড়ল পুলিশের। জটিল রহস্য। সমাধানে হিমশিম খাওয়া পুলিশ ধর্না দিল সান্তা ক্লজের মতো পাকা দাড়ির দীর্ঘদেহী এক বুড়োর।


কিংবা বর্ধমানের সীমান্তে খনি এলাকা ভৈরবগড়ের ওই খুনের কেসটার কথাও বলতে পারি। কয়েক দিনের মধ্যে যেখানে ঘটে তিনটি হত্যাকান্ড। প্রথম ও তৃতীয়জন ব্যবসায়ী, দ্বিতীয় জন অবসরপ্রাপ্ত মাইনিং ইঞ্জিনিয়ার। মৃত্যুর আগের দিন তিনজনের কাছেই এসেছিলেন এক তান্ত্রিক সাধু বাবা। প্রত্যেকটা লাশ পাওয়া গিয়েছে ভৈরব মন্দিরের চত্বরে, সবার পিঠের দিকে হার্টের পেছনে তিনটি গভীর ক্ষতচিহ্ন। হত্যাকান্ডগুলোর মধ্যে আরো একটি যোগসূত্র আছে। প্রতিবারই খুনের পর ভৈরব মন্দিরের চূড়ায় আটকানো ত্রিশুলে মিলেছে টাটকা রক্ত। বিংশ শতকেও নরবলি! নাকি আরো জটিল কোনো রহস্য! ব্যাস খনি এলাকা ভৈরব গড়ে গন্ধ শুকে শুকে হাজির টাক মাথার বুড়ো।


এই বুড়োর পরিচয় যারা এখনো আবিষ্কার করতে পারেননি তাদের বলছি ইনিই সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের অনবদ্য সৃষ্টি কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। সত্যি বলতে বাংলা-ইংরেজি রহস্যসাহিত্য মিলিয়ে হিসাব করলে আমার সবচেয়ে পছন্দের দুই তিনটি চরিত্রের একটি এই নীলাদ্রি সরকার। তবে এটাও সত্যি রহস্যপ্রিয় পাঠকরা ফেলুদা, শার্লক হোমস, মিস মার্পলের মতো চরিত্রগুলোকে যতোটা চেনেন ততটা চেনেননা নীলাদ্রি সরকারকে। অথচ স্বয়ং সত্যজিৎ রায়ও নীলাদ্রি সরকারের ভক্ত ছিলেন। এমনকী মুস্তাফা সিরাজকে সন্দেশ পত্রিকায় কর্নেলকে নিয়ে লিখার জন্য অনুরোধ করে চিঠিও লিখেছিলেন। এই সব কিছু মিলিয়েই প্রিয় কর্নেলকে নিয়ে লিখতে বসা।


বলতে পারেন নীলাদ্রি সরকার আর পাঁচ-দশটা গোয়েন্দা চরিত্রের থেকে একেবারেই আলাদা। অবশ্য নিজেকে গোয়েন্দা বলে পরিচয়ও করান না। একই সঙ্গে আবার রহস্যই সামরিক বাহিনির অবসরপাপ্ত এই কর্মকর্তার ধ্যান-জ্ঞান। মাথার টাকটা বেশিরভাগ সময় ঢাকা পড়ে থাকে টুুপিতে, মুখভর্তি লম্বা সাদা দাড়ি-গোঁফ, বয়সে বৃদ্ধ হলে কী হবে গায়ে প্রচণ্ড শক্তি, অনায়াসে পাহাড় বাইতে পারেন, হাঁটতে পারেন অনেকটা পথ, পিঠের কিটব্যাগ থেকে উঁকি দেয় প্রজাপতি ধরার জাল, গলায় ঝুলে বাইনোকুলার আর ক্যামেরা। প্রথম দেখায় মনে হবে বিদেশি ট্যুরিস্ট, আসলে বাঙ্গালি।


এই চরিত্রটি সৃষ্টির গল্পটাও ভারি মজার। ১৯৫৬ সালের এক শীতকাল। মুর্শিদাবাদের লালবাগের ঐতিহ্যবাহী হাজার দুয়ারি প্রাসাদে গিয়েছিলেন মুস্তাফা সিরাজ। হঠাৎ চোখ আটকে গেল সান্তার মতো পাকা গোঁফদাড়ির এক বৃদ্ধে। টকটকে ফরসা রং। প্যান্ট শার্টে পড়নে। পিঠে কিটব্যাগ। বাইনোকুলার দিয়ে দূরের কোনো কিছুতে ছিল নজর। মুখ তুলতেই টুপি খসে বেরিয়ে পড়ল টাক, রোদ পড়ে ঝলমল করছিল। গুড়ি মেরে রহস্যজনকভাবে এগিয়ে যাচ্ছিলেন একটা ঝোপের দিকে। আশপাশে উৎ পেতে থাকা গাইডদের একজন সামনে উদয় হয়ে বিদেশী ভেবে তাকে একটা ধ্বংসস্তূপের বর্ণনা দিচ্ছিল ভুল ভাল ইংরেজিতে। তখনই বুড়ো উঠে দাঁড়িয়ে বাংলায় বলে উঠলেন, এই প্রজাপতিগুলো বড্ড সেয়ানা। গাইডের তো রীতিমত ভিড়মি খাবার যোগাড়, এমনকী চোখ কপালে মুস্তাফা সিরাজেরও। তিনিও যে এই বৃদ্ধকে বিদেশিই ভেবে বসেছিলেন!


এর বহু বছর পর এক সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদকের তাড়ায় ধারাবাহিক উপন্যাস লিখতে গিয়ে লেখকের মাথায় চলে এলো ওই বুড়োর কথা। ব্যাস, তার আদলে বানিয়ে ফেললেন কর্নেল নীলাদ্রি সরকার চরিত্রটি। সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের ওই রহস্যোপন্যাসটির নাম, ছায়া পড়ে।


কোথাও দুর্লভ প্রজাপতি, পাখি, অর্কিড, ক্যাকটাসের খবর পেলেই হলো, হাজির হয়ে যান। তা সেটা যতো দুর্গম পাহাড় কিংবা অরণ্যই হোক না কেন। তবে তাঁর সবচেয়ে বড় খেয়াল রহস্যের পিছু নেওয়া। লাল বাজারের দুঁদে গোয়েন্দারা যেখানে ব্যার্থ সেখানেই শুরু নীলাদ্রি সরকারের। কখনো তাঁর সাহায্য চাইতে হাজির হয়ে যায় গোয়েন্দা বিভাগের ডিসি ডিবি অরিজিত লাহিড়ী, কিংবা লাল বাজারের অন্য কোনো গোয়েন্দা। কর্নেল হয়তো তখন তাঁর ইলিয়ট রোডের তিন তলা দালানটার প্রিয় ছাদ বাগানে শত মাইল দূরের কোনো পাহাড়ি বনাঞ্চল থেকে সংগ্রহ করে আনা গাছের যত্ন নিচ্ছেন। অতিথিকে অভ্যর্থনা জানায় কর্নেলের একান্ত বিশ্বস্থ্য ভৃত্য ও গাছপরিচর্যার সঙ্গী ষষ্ঠীচরণ।


মোটামুটি বেশিরভাগ অভিযানে কর্নেলের সাথে থাকে দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার ক্রাইম রিপোর্টার জয়ন্ত চৌধুরী। দুর্ধর্ষ অ্যাডভেঞ্চারগুলো জয়ন্তর মাধ্যমেই জানতে পারে পত্রিকার পাঠকরা। তবে সাংবাদিক হিসাবে তুখোড় হলেও জয়ন্তর রহস্যভেদী বুদ্ধি মোটেই আহমরী কিছু নয়। অবশ্য বেশিরভাগ বিখ্যাত গোয়েন্দা কাহিনির পার্শ্ব চরিত্ররাই কাহিনির প্রয়োজনে একটু কম বুদ্ধির হয়।


কর্নেলের বইগুলোর আরেক অসাধারণ সংযোজন অবসরপ্রাপ্ত দারোগা ও পরবর্তীতে প্রাইভেট ডিটেক্টিভ কৃতান্ত কুমার হালদার। অনেক সময়ই দেখা যায় নিজের কোনো কেসে কিংবা কর্নেলকে সাহায্য করতে গিয়ে নানান অদ্ভুত কাণ্ডকীর্তি ঘটাচ্ছেন হালদার মশাই। পাঠকরা এসব ঘটনার বর্ণনা পড়ে কখন হাসতে শুরু করেছেন নিজেরাই টের পান না। বলা চলে এই চরিত্রটির উপস্থিতি কাহিনিতে একটা নতুন মাত্রা যোগ করে। মুস্তাফা সিরাজ নিজেই হালদার মশাইবক উল্লেখ করেছেন তাঁর রিলিফ হিসাবে। কে কে হালদারের আঞ্চালিক ভাষায় কথা বলার স্টাইলটাও আমার বেশ লাগে।


কর্নেলের বইগুলো পড়তে গিয়ে তার সঙ্গে অসাধারণ সব জায়গায় ভ্রমণও হয়ে যাবে আপনার। আমার যেমনটা হয়। কখনো নেপাল সীমান্তের ডমরু পাহাড়ে, কখনো পার্বত্য শিল্প এলাকা রানীডিহি বা বাংলা বিহার সীমান্তের খনি এলাকা বারাহিয়া কিংবা উড়িষ্যার সাগর তীরবর্তী গোপালপুর অন সী, চন্দনপুর অন সি, নতুবা ধরমপুরের ধরিয়া ফলসে পৌঁছে যাই। বুড়োর সঙ্গে সারস পাখির খোঁজে করতে গিয়েও রহস্যের পাকে আটকা পড়ে যাই। এসব দুর্গম জায়গায় গিয়ে অসাধারণ সুন্দর কোনো সেচ বাংলো কিংবা সরকারি অন্য কোনো বাংলোতে থাকার সুযোগ হয়ে যায় কর্নেল আর জয়ন্ত চৌধুরীর বদন্যতায়।


তবে কর্নেলের সঙ্গে জোট বাধার আগে একটি সাবধানবানী। খুনোখুনি লেগেই থাকে তার বইয়ে। তাই উত্তেজনার মাত্রাটাও বেশি, কখনো আবার একটু বড়দের উপযোগী ঘটনা কিংবা রগরগে বর্ণনাও থাকে, কিছু বই আবার একেবারেই কিশোর উপযোগী। মোটের ওপর ছেলে-বুড়ো সবার জন্যই কর্নেল লেখা হয়েছে। আমার মতো রহস্য ও প্রকৃতি প্রেমিকের জন্য এর চেয়ে সরস কাহিনি পাওয়া মুশকিল। এতক্ষণে নিশ্চয় বুঝে গিয়েছেন, কেবল পাড় গোয়েন্দা কাহিনির ভক্তরা নন অ্যাডভেঞ্চার কিংবা বন-জঙ্গল ও বন্যপ্রাণীপ্রেমী পাঠকদের জন্যেও অসাধারণ এক চয়েজ হতে পারে সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের কর্নেল। পড়তে পড়তে এতোটাই বুঁদ হয়ে যাবেন মনে হবে কফি আর চুরুটপ্রেমী বুড়ো যেন আপনার কানের কাছে ফিসফিস করে বলছে, ডার্লিং‍! ভয় লাগছে না তো!

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

buttons=(Accept !) days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Learn More
Accept !