বইঃ সিন্ধু থেকে বঙ্গ
লেখকঃ মনযূর আহমেদ
প্রকাশনীঃ চেতনা প্রকাশনী
পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ১১০০ (দুই খন্ড)
মুদ্রিত মূল্যঃ ১৬০০ (দুই খন্ড)
ইতিহাস কী? এর প্রভাব কোথায়? কেনই বা তা জানা প্রয়োজন?
এই প্রশ্নগুলোর সঠিক উত্তর জানা অবশ্যক, নিজেদের অস্তিত্বের জন্য, অতীতের সাথে সংযোগ স্থাপন ও ইতিহাসের শিক্ষাকে মানবজীবনের নানান চড়াই-উতরাই এ কাজে লাগানোর জন্য। ইতিহাস আমাদের সংযোগ ঘটায় শিকড়ের সাথে, অস্তিত্বের সাথে, আত্মপরিচয় উপলব্ধি করতে। তাই
শিকড়ের সন্ধান পেতে হলে জানতে হবে ইতিহাস, তা সে যেই ধর্মাবলম্বীর অনুসারীই হোক না কেন! সত্যকে জানতে হলে পাতায় পাতায় সংরক্ষিত নির্ভরযোগ্য ইতিহাস বিষয়ক গ্রন্থে ডুব দিতে হবে। যাচাই করতে হবে সেই ইতিহাসের সত্যতা। তাই প্রয়োজন দীর্ঘ গবেষণার কিংবা অধ্যবসায় এর। ইতিহাসের বৃহৎ কলেবরের মোড়ানো ঘটনাবলি জানতে প্রয়োজন অসংখ্য পুস্তক, সময় ও সঠিক তথ্য সংবলিত ও ক্রমান্বয়ে বর্ণিত ইতিহাস। যা সত্যিই বেশ দুরূহ ঠেকে আজকাল। আর তাই সাধারণ পাঠকের প্রয়োজন নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক গ্রন্থ। যেই গ্রন্থে পাওয়া যাবে নিজেদের অস্তিত্ব ও উৎপত্তি, সভ্যতা, সংস্কার ও সংস্কৃতি, শিল্প-স্থাপত্য এবং শাসনব্যবস্থায় পূর্বপুরুষদের অবদান ও পারদর্শীতা।
এই কাজটিই অত্যন্ত সহজ হয়ে গেছে বলে মনে হলো "সিন্ধু থেকে বঙ্গ" বইটির সূচিপত্র দেখার পর। মনে মনে এমন একটি বই খুঁজছিলাম বহুদিন ধরে। যেখান থেকে ক্রমান্বয়ে সবগুলো ঘটনা পড়া যাবে, এমনকি যাচাইও করা যাবে অত্যন্ত সহজভাবে, কম সময় ব্যয় করে, প্রাসঙ্গিক উৎস থেকে।
বিষয়বস্তু:
দুই খণ্ডে বিভক্ত বইটির প্রথম খণ্ডে রয়েছে ২১ টি অধ্যায়। যেখানে বর্ণিত হয়েছে ভারতীয় উপমহাদেশের বিস্তৃত ইতিহাস। প্রথম খণ্ডের শুরুটা বেশ চমকপ্রদ। এই নশ্বর পৃথিবীতে মানব জাতির আবির্ভাবটাও দারুণভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। মানবাজাতির জন্য ইবরাহিম আলাইহিস সালামের মুনাজাত থেকে শুরু করে ভারতীয় উপমহাদেশে আর্যদের আগমন ও তাদের পরিচয়, প্রাচীন ভারতের শিক্ষাব্যবস্থা,ইসলাম প্রচারে ওলি-আউলিয়ার অবদান, বঙ্গে ইসলাম প্রচার, মুসলিম শাসনের সূচনা, সিন্ধু বিজয় এবং রাজবংশগুলোর ইতিহাস বর্ণনা করা হয়েছে অত্যন্ত সাবলীলভাবে। যেখানে বিভিন্ন শাসনামলের শাসকদের বৈশিষ্ট্য, কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা, বিচারবিভাগ, ধর্মনিষ্ঠা, ধর্মীয় নীতি, সামাজিক অবস্থা, হিন্দুদের অবস্থা, শিল্প ও বাণিজ্য, সংস্কৃতি ও সাহিত্যে মুসলমানদের অবদান ও সভ্যতায় ইসলামের অবদানও উঠে এসেছে।
দ্বিতীয় খণ্ডের সম্পূর্ণ অংশ জুড়ে রয়েছে মুঘল শাসনামলের ঐতিহাসিক সকল ঘটনার সন্নিবেশ। মুঘল সাম্রাজ্যের বিশেষত্ব সম্পর্কে অধিকাংশ পাঠকই সামান্য হলেও অবহিত বলেই আমার বিশ্বাস। তবে বৃহৎ পরিসরে জানার জন্য এই বইটির বিকল্প নেই।
মুসলামদের রাজত্বকালের দীর্ঘ ইতিহাসে মুঘল সাম্রাজ্যের অবদানের বিশালতা একে অন্য শাসনামল থেকে পৃথক করে। তাই এই সাম্রাজ্যের অবদান অনস্বীকার্য।
২য় খন্ডটি সাজানো হয়েছে মোট ২০ অধ্যায়ের সমন্বয়ে। পানিপথের প্রথম যুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমে সম্রাট বাবরের হাত ধরে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে সকল মুঘল সম্রাটের শাসনব্যবস্থা ও শাসনকাল, যুদ্ধ-বিগ্রহ, ধর্মীয় ও সামাজিক অবস্থাসহ মুঘল শাসনব্যবস্থায় সমাজ ও সংস্কৃতি, হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক, শিল্প ব্যবস্থা, শিক্ষা-সাহিত্য, স্থাপত্যশিল্প এবং ভারতবর্ষে সভ্যতা বিনির্মাণে ইসলামের ঐতিহাসিক অবদান এমনকি মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের কারণও বিবৃত হয়েছে। মুঘলদের এই পতনের পেছনের কারণগুলো কী হতে পারে? ক্ষমতার পালাবদল কী বয়ে এনেছিল বাঙালি ও মুসলমানদের ভাগ্যে?
মুসলমানদের গৌরবময় ইতিহাসের এই কালানুক্রমিক ধারা ও তাদের পতনের কারণ জানতে হলে "সিন্ধু থেকে বঙ্গ" বইটি পড়তে হবে। একজন পাঠক হিসেবে আশা করছি পাঠকরা এই বইটি পাঠ করে তাদের জ্ঞানের তৃষ্ণা মেটাতে সক্ষম হবে। পাঠকতুষ্টিই এনে দেবে বইটির সফলতা।
বইটি যে কারণে পড়া উচিত:
সম্পূর্ণ ইতিহাসকে সবিস্তারে কালানুক্রমিক বিস্তৃত করতে প্রয়োজন অফুরন্ত ধৈর্য, অনুশীলন ও সাহসের। পাঠকের কষ্ট লাঘবের স্বার্থে লেখককে যে পরিমাণ কষ্ট ও অনুশীলন করার প্রয়োজন হয়েছে তা দৃশ্যমান। পাঠক উপকৃত হলেই লেখকের সকল পরিশ্রম সার্থক। লেখক ও সম্পাদক মনযুর আহমদ এবং চেতনা প্রকাশনীর এই কষ্ট, শ্রম সৃষ্টিকর্তার অশেষ কৃপায় সার্থক হবে বলে আমি আশাবাদী ।
বাংলা ভাষী মানুষদের জন্য "সিন্ধু থেকে বঙ্গ" বইটি একটি "Invaluable Gem" বলে স্বীকৃত হওয়া উচিত। ভারতীয় উপমহাদেশে আর্যদের সিন্ধু অঞ্চলে বসতি স্থাপন থেকে শুরু করে মুসলমানদের ক্ষমতা লাভ ও সামাজিক, রাজনৈতিক, শিক্ষা, সভ্যতা, সংস্কার, সংস্কৃতিতে মুসলমানদের অবদান নিয়ে পূর্ণাঙ্গ ও নির্ভরযোগ্য পুস্তক পাওয়া যেখানে দুরূহ একটি ব্যাপার সেখানে চেতনা প্রকাশনী এই বইটি প্রকাশের ঘোষণা দিয়ে আলোকবর্তিকা হাতে পাঠকদের মানসপটে আলোকচ্ছটা ফেলে হাতছানি দিয়ে আলোক উৎসের দিকে আহবান করছে। সেই আলোর ঝলকানিতে অস্তিত্ব ও ইতিহাসবিমুখ ঘুমন্ত পাঠকরাও এবার জেগে উঠে অস্তিত্বের পরিচয়ে বলীয়ান হবে বলেই একজন পাঠক হিসেবে আমার বিশ্বাস।
প্রশংসনীয় দিক:
একজন মানুষকে তার অস্তিত্ব সম্পর্কে জ্ঞান রাখাটা অবশ্যক। এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাহায্য পাওয়া যায় ভালো ও পূর্ণাঙ্গ পুস্তক অধ্যয়নের মাধ্যমে। পাশাপাশি থাকা চাই ঘটনার প্রাসঙ্গিকতা ও সুন্দর উপস্থাপন। সিন্ধু থেকে বঙ্গ বইটি দেখে আমার কাছে মনে হয়েছে লেখক এইসব দিকে বেশ সতর্ক দৃষ্টি দিয়েছেন। আরও একটি বিষয় না বললেই নয়, যেকোনো মানুষের গ্রহণযোগ্যতা বহুগুণে বৃদ্ধি করে দেয় সেই মানুষটির বিনয়। লেখক এতো সুবিস্তর জ্ঞানের চর্চায় থেকেও ভীষণ বিনয়ী। যার প্রমাণ পাওয়া যায় লেখকের নিজেকে পাঠক হিসেবে পরিচয় দেওয়ার মাধ্যমে।
নিজস্ব মতামত:
ইতিহাসপ্রেমী পাঠক ও প্রতিটি জ্ঞানপিপাসু মানুষ সবচাইতে বেশি আশ্চর্যান্বিত হবে সূচিপত্রের ক্রম ও শিরোনাম দেখে। পাঠকমাত্রেরই মনে হবে, এখানে কিছুই বাদ দেওয়া হয়নি, সবকিছুই উল্লেখ করা হয়েছে। তা মানব জাতির গোড়াপত্তন হোক কিংবা হোক শাসনব্যবস্থা, শিল্প, সাহিত্য, স্থাপত্য, ধর্মীয় রীতিনীতি। আশা করছি, চেতনা প্রকাশ ও লেখকের যৌথ প্রয়াস মুসলমানদের ঘুমন্ত চেতনাকে নাড়া দিতে সক্ষম হবে।
উল্লেখ্য, এই বইটি সাধারণ পাঠক ছাড়াও চাকরিপ্রার্থীদেরও উপকারে আসবে। এক্ষেত্রে প্রচারণার কোনো বিকল্প নেই। কথায় আছে, প্রচারেই প্রসার। প্রচার না হওয়ার কারণে অনেক ভালো বই আলোর মুখ দেখে না। "সিন্ধু থেকে বঙ্গ" বইটির প্রচার ও প্রসারে চেতনা প্রকাশনের গৃহীত সকল উদ্যোগ সফল হবে, ইনশাল্লাহ্।
প্রিভিউ শেষ করতে চাই বইটির একটি চমৎকার উক্তি দিয়ে,
“ইতিহাস হচ্ছে আমার চোখ, বিবেক ধারানোর রেত, চলার পথের নির্ভরযোগ্য বাহন।”