কেউ কেউ কথা রাখে pdf - মোহাম্মদ নাজিম উদ্দীন

 


বই : কেউ কেউ কথা রাখে

লেখক  : মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

প্রকাশনী : বাতিঘর প্রকাশনী



কেউ কেউ কথা রাখে রিভিউ ও pdf


মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিনের আটটা মৌলিক উপন্যাসের পরে তাঁর করা একটা অনুবাদ পড়া শুরু করেছিলাম। বইটার নাম 'কেউ কেউ কথা রাখে ৷' এটার মূল লেখক  আর্জেন্টিনার জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক এডুয়ার্ডো সাচেরি। তাঁর বইটা স্প্যানিশ ভাষায় লেখা। নাম হচ্ছে, ‘’লা প্রেগুনতা দে সাস ওহোস'। বইটা ইংরেজিতে অনুদিত হয়েছে 'দ্য সিক্রেট ইন দেয়ার আইজ' নামে। এটা একটা থ্রিলার উপন্যাস। মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন এটাকে।


মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিনের মৌলিক আটটা গ্রন্থ পড়ার পরে আমার কাছে মনে হয়েছিলো 'রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেননি' হচ্ছে তাঁর সেরা সৃষ্টি। 'কেউ কেউ কথা রাখে' পড়ার পরে সেই ধারণায় চিড় ধরেছে আমার। এই বইটাকেই এখন আমি আমার বিবেচনায় তাঁর সেরা সৃষ্টি হিসাবে স্বীকৃতি দেবো। আমার এই বক্তব্য শুনে আপনাদের ভ্রু কুঁচকে যেতে বাধ্য। কারণ, এটা তাঁর মৌলিক কোনো সৃষ্টি না। একজন বিদেশি লেখকের লেখাকে অনুবাদ করেছেন তিনি মাত্র। একটা অনুবাদ গ্রন্থকে ভালো অনুবাদ, চলনসই অনুবাদ কিংবা খারাপ অনুবাদ বলা যেতে পারে। তাঁর নিজস্ব সৃষ্টি কিছুতেই নয়। অনুবাদকে যেখানে নিজস্ব সৃষ্টি বলারই সুযোগ নেই, সেখানে তাঁর সেরা সৃষ্টি বলাটা নিছকই পাগলামিই।


এই বিষয়টা আমি বুঝি। বোঝার পরেও বলছি, আমার মতে এটাই মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিনের সেরা কাজ। কেনো বলছি সেটার ব্যাখ্যা নীচে দিচ্ছি আমি।


অনুবাদ বলতে যা বোঝায়, সেই কাজটা মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন এখানে করেননি। অনুবাদে আমরা সাধারণত দুই ধরনের কাজ করি। একটা হচ্ছে সরাসরি অনুবাদ। আরেকটা হচ্ছে ভাবানুবাদ। মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন এর কোনোটাতেই যাননি। সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা কাজ করেছেন তিনি। তিনি যে কাজটা করেছেন, সেটা তাঁর ভাষাতেই বলি আমি।


“এই বইটা (লা প্রেগুনতা দে সাস ওহোস) আমাকে ভীষণ মুগ্ধ করে। সিদ্ধান্ত নেই অনুবাদ করার জন্য, কিন্তু কাজ শুরু করতে গিয়ে বুঝতে পারলাম অভ্যাস খারাপ হয়ে গেছে। মৌলিক লিখতে লিখতে অনুবাদ করা ভুলে গেছি। মূল কাহিনী আর চরিত্রগুলোকে পাশ কাটিয়ে নিজের মতো করে চরিত্র আর কাহিনী লিখতে শুরু করে দিয়েছি। সম্ভবত এর কারণ, ঐ সময় আমার মাথায় সাচেরির গল্পটির মতোই একটি পিরিওডিক্যাল মার্ডার মিস্ট্রি ঘুরপাক খাচ্ছিলো। অন্যদিকে, মূল উপন্যাসের সময়কাল আর রাজনৈতিক আবহের সাথে আমাদের দেশের একটি সময়ের আশ্চর্য রকমের সাযুজ্যও খুঁজে পেয়েছিলাম।


যাই হোক, লেখাটা যখন শেষ করলাম তখন সেটা আর অনুবাদ রইলো না, আবার পুরোপুরি মৌলিক বললেও এদুয়ার্দো সাচেরির প্রতি অবিচার করা হবে।


পাঠককে বলবো, 'কেউ কেউ কথা রাখে' পুরোপুরি নিরীক্ষাধর্মী একটি কাজ।"


মূল উপন্যাসের সময়কালের সাথে আমাদের দেশের যে সময়কালটার আশ্চর্য রকমের সাযুজ্য মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন খুঁজে পেয়েছিলেন, সেটা বাংলাদেশের জন্য একটা ক্রান্তিকাল। সেটা নিয়ে আলোচনার আগে মূল উপন্যাসের সময়কালটাকে বোঝার চেষ্টা করি আগে আমরা।


১৯৭৬ সাল থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত আর্জেন্টিনার সময়কালকে বলা হয় 'গুয়েরা সুসিয়া' বা 'ডার্টি ওয়ার' টাইম। অস্থির এবং বিপদজনক একটা সময়। এই নোংরা যুদ্ধের সময়কালে আর্জেন্টিনার রাষ্ট্র ব্যবস্থা রাজনৈতিক সহিংসতার প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলো। সশস্ত্র গেরিলা থেকে শুরু করে ছাত্র, রাজনৈতিক কর্মী, শ্রমিক, শিক্ষক, সাংবাদিক, বামপন্থী, কেউ বাদ যায়নি রাষ্ট্রের নির্যাতনের হাত থেকে। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের কারণে সেই সময় গুম হয়ে গিয়েছিলো তেরো হাজার মানুষ। কেউ কেউ এই সংখ্যাকে তিরিশ হাজার বলেও দাবি করেছে।


স্বাধীনতার পরে এ রকম একটা অস্থির সময়ের মধ্য দিয়ে আমরাও গিয়েছি। সদ্য স্বাধীন দেশে গণ মানুষের বিপুল প্রত্যাশা এবং কঠোর বাস্তবতার মধ্যে আকাশ-পাতাল এক ব্যবধান তৈরি হয়ে গিয়েছিলো। পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনে আকাশ ছোঁয়া এক স্বপ্ন নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলো বাংলাদেশের মানুষ। কিন্তু, অচিরেই তাদের সেই স্বপ্ন ফিকে হয়ে যায়। হতাশার এক অতল গহবরে নিক্ষিপ্ত হয় মানুষ। বাংলাদেশের স্বাধীনতার যিনি স্বপ্ন পুরুষ ছিলেন, যিনি সাড়ে সাত কোটি মানুষকে হ্যামিলনের বাঁশি ওয়ালার মতো মোহাবিষ্ট করে পাকিস্তানের শৃঙ্খল থেকে ভেঙে বের হয়ে আসার জন্য নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, সেই তিনিই রাষ্ট্র নায়ক হিসাবে ব্যর্থতার দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন। সেই ব্যর্থতা থেকে বের হয়ে আসতে গিয়ে নানা ধরনের ভুল পদক্ষেপও নিতে থাকেন তিনি। চেষ্টা করতে থাকেন নিজের হাতে যতো বেশি ক্ষমতা নেওয়া সম্ভব তার সবটুকু নেবার। এর ফলে ক্রমে ক্রমে গণতন্ত্র দুর্বল হয়ে যেতে থাকে। সেই সময়ে সমাজের মধ্যেও নানা-মুখী দ্বন্দ্ব তৈরি হয়, নানা ধরনের মতাদর্শের মানুষও চরম মুখী আচরণ করতে থাকে। জাসদ নামে একটা বামপন্থী সংগঠনের জন্ম হয়। এরা অতি দ্রুত নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি থেকে সরে গিয়ে চরমপন্থা অবলম্বন করতে থাকে। জাসদের চরমপন্থার দিকে ঝোঁকার আগে থেকেই সর্বহারা নামের আরেকটি চীনপন্থি নিষিদ্ধ সংগঠন অস্ত্র হাতেই সক্রিয় ছিলো। এইসব চরমপন্থীদের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে রাষ্ট্রও আইন-আদালতের উপর ভরসা হারিয়ে ফেলে। তার বদলে অ-নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে এদের মোকাবেলা শুরু করে। এদেরকে ধরে বিচার করার পরিবর্তে রাষ্ট্র গুম, খুন, অত্যাচার-নির্যাতনকে প্রশ্রয় দেওয়া শুরু করে। অভিযোগ আছে সেই সময়ে জাসদের প্রায় বিশ হাজার তরুণ নিহত হয়েছিলো রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতে। সর্বহারা পার্টির প্রধান সিরাজ সিকদার পুলিশের হাতে বন্দি হবার পরেও রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ডের শিকার হন।


এডুয়ার্ডো সাচেরির বর্ণিত আর্জেন্টিনার সেই অস্থির সময়কালকে পরিবর্তিত করে মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন এই উপন্যাসের পটভূমিকায় নিয়ে আসেন বাংলাদেশের চুয়াত্তর এবং পঁচাত্তর সালকে। এটা করতে গিয়ে স্বাভাবিকভাবেই মূল উপন্যাসের চরিত্রগুলোকে পাল্টাতে হয়েছে তাঁর। সেখানে সংযোজন-বিয়োজন ঘটেছে। সেটা তিনি করেছেন অসম্ভব দক্ষতার সাথে।


একটা মেয়ের ধর্ষিতা হয়ে খুন হবার ঘটনা দিয়ে শুরু হয়েছে এই উপন্যাস। কে তাকে খুন করেছে সেটা খুঁজে বের করাই হচ্ছে গল্পের মূল প্লট। হাজার হাজার থ্রিলারের সাথে এই প্লটের আলাদা কোনো বৈশিষ্ট্য নেই। এর বিশিষ্টতা অন্য জায়গায়। ওই যে সময়কালটা বললাম, সেটা। এই উপন্যাসে হত্যা রহস্যে উন্মোচনের চেয়েও অনেক বেশি উন্মোচিত হয়েছে সেই সময়ের রাজনৈতিক এবং সামাজিক অস্থিরতা। অসামান্য দক্ষতা এবং মুনশিয়ানায় মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন সেটাকে তুলে এনেছেন। এই বই পড়ার সময়ে বাংলাদেশের ওই সময়কার রাজনৈতিক পরিস্থিতিটা চোখের সামনে ভেসে উঠবে পাঠকের। ফলে, 'কেউ কেউ কথা রাখে' শুধুমাত্র একটা রহস্য-রোমাঞ্চ উপন্যাস হিসাবে থেমে থাকে নাই, হয়ে উঠেছে একটা বিশুদ্ধ রাজনৈতিক উপন্যাস।


'কেউ কেউ কথা রাখে' পড়ার পরে কৌতূহল বশে এডুয়ার্ডো সাচেরির মূল বইটাও ইংরেজিতে পড়েছি আমি। দুটো বইকে পাশাপাশি রেখে তুলনা করার চেষ্টা করেছি। সেই তুলনা করতে গিয়ে একটা জিনিস দেখে দারুণভাবে আশ্চর্য হয়েছি। বলা হয়েছে এটা অনুবাদ। অথচ, এক অনুচ্ছেদতো অনেক দূরের কথা, দুটো বইয়ের একটা লাইনও মেলে না। খুনের ঘটনা এবং এর সাথে জড়িত প্রধান ঘটনাগুলোকে বাদ দিলে বাকি সবকিছুই মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন নিজের মতো করেই লিখেছেন। অনুবাদের ক্ষেত্রে এটা একটা বিরল ঘটনা। আমার ধারণা হচ্ছে মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন যদি বলে না দিতেন যে এটা একটা অনুবাদকর্ম, বহু পাঠকই ধরতে পারতো না সেটা।


বইটার নামকরণ নিয়ে ছোট্ট একটু কথা বলে শেষ করি। একটা থ্রিলার গল্পের নামকরণ হিসাবে এটা একটা বেমানান নামকরণ। কবিতা-প্রেমীরা জানেন এই লাইনটা মূলত সুনীলের বিখ্যাত কবিতা 'কেউ কথা রাখেনি' থেকে এসেছে। শুধু এই উপন্যাসই নয়, মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন তাঁর অন্যান্য বইয়ের ক্ষেত্রেও অদ্ভুত ধরনের কিছু নাম দিয়েছেন। তাঁর সবচেয়ে আলোচিত বই, ‘রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেননি' কিংবা '১৯৫২ঃ নিছক কোন সংখ্যা নয়' এর কথা উল্লেখ করতে পারি আমি। যদিও আমি বেমানান নামকরণ বলেছি, বাস্তবে কিন্তু তেমন নয়। বইটা পড়া শেষ করার পরে পাঠকের কাছে মনে হবে এই উপন্যাসের জন্য এর চেয়ে যথার্থ নাম আর কিছু হতে পারতো না। কাজেই, উনি না বুঝেই বইয়ের নাম দেন, কিংবা গিমিক সৃষ্টি করার জন্য করেন, সেই ধারণা নিয়ে যাঁরা বসে আছেন, তাঁরা দ্বিতীয়বার ভেবে দেখতে পারেন। গিমিক সৃষ্টি নয়, বরং নামকরণের ক্ষেত্রেও তিনি আসলে একজন সৃষ্টিশীল মানুষ, এটাই আমার ধারণা। রিভিউ লেখকঃ ফরিদ আহমেদ 


কেউ কেউ কথা রাখে pdf

ডাউনলোড করুন ]


Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

buttons=(Accept !) days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Learn More
Accept !